তারপর একদিন সত্যি সত্যিই গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে প্রথম শ্রেনীতে ভর্তি হলাম, অনেক বড়ো হয়ে । আর একদিকে গ্রামের জুম্মা মসজিদে মক্তবে আরবী পড়তে শুরু করলাম । দ্বিতীয় শ্রেনী থেকে তৃতীয় শ্রেনীতে একশ শতাংশ নাম্বার নিয়ে উত্তীর্ণ হলাম । তবু সেই সমই বাড়ি থেকে বললো – স্কুলে যাওয়া হবে না । সংসারে অভাব – কাজ করতে হবে । স্কুল যাওয়া আমার বন্ধ হয়ে গেল । আমি এয়ার রিভার পাম্প চালাতে লাগলাম । তবু মন পড়ে থাকে স্কুল আর মক্তবের দিকে । যদি আমাদের আর্থিক অবস্থা ভাল থাকতো হয়তো স্কুল যাওয়া বন্ধ হত না, দারিদ্রের ঘেরাটোপে আমার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেল । কিন্তু কোন কাজ করতে মন বসে না, কিছুই ভালো লাগে না । মনের ভেতর একটা অশান্তির বাতাস বইতে থাকে । একদিন রিভার পাম্পের ট্রান্সমিটারের সমস্ত ফিউজের তার কেতে দিলাম – যাতে কেউ আমার খোঁজ না করে, পরে বিদ্যুৎ এলে আবার আমার খোঁজ করবে । তারপর মাত্র 11 টাকা, একটা লুঙ্গি ও একটা জামা নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে । কিন্তু কিছুই জানিনা, কিছুই চিনিনা । আল্লাহর ওপর ভরসা করে যাত্রা শুরু করলাম - সালটি ছিল 1988, মুর্শিদাবাদের লালবাগের কাটরা মসজিদে জুম্মার নমাজ পড়াকে কেন্দ্র করে গন্ডগোলের কিছুদিন পর । কলাডাঙ্গা থেকে দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে পঞ্চাননতলায় পৌঁছালাম । এখানে একজনকে জিজ্ঞাসা করে বাসে চেপে বেলডাঙ্গায় গেলাম, যখন বেলডাঙ্গায় পৌঁছালাম তখন প্রায় সন্ধ্যেবেলা, সেখানে একজন মৌলানা সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলাম এখানে মাদ্রাসা কোথায় ? তিনি বললেন – সঙ্গে অভিভাবক না এলে ভর্তি নেবো না, ছাত্র সেজে এসে চুরি করে পালায় । তিনি বললেন – সোজা রাস্তা ধরে চলে যাও, রাস্তার বাম দিকে একটি মাদ্রাসা আছে । আমি সোজা হাঁটতে লাগলাম, পথে মধ্যে একটি দোকানে মাগরিবের নমাজ পড়ে মাদ্রাসায় পৌঁছালাম – সেখানে পৌঁছে আমার চোখের জল আর ধরে রাখতে পারলাম না । যাই হোক দুই ছাত্র এসে আমাকে নিয়ে গেলো । সেখানে ছিলেন মানিকনগরের মৌঃ আরস ভাই – আল্লাহ পাক তাঁর ভালো করুক । সেই মাদ্রাসাটি ছিল বেলডাঙ্গা সুরুলিয়া মাদ্রাসা, সেখানে দুদিন থাকার পর আমাকে চন্দ্রহাট হালিবাসিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি করে দিলেন । তখন মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক ছিলেন মারহুম মৌঃ ইলিয়াস সাহেব, তিনি আমাকে অভয় দিলেন - আল্লাহ পাক তাঁকে জান্নাতি করুন । আমার সাফল্যের পেছনে তাঁরও অবদান অনেক । পাঁচ দিন পর বাবা খুঁজতে খুঁজতে মাদ্রাসায় এলেন, তখন বাবার আর আমার চোখে বারি ধারা ছ্বলছ্বল করছিল, দুজনের মধ্যে কিছু বাক্য বিনিময় হলো আর তারপর থেকে শুরু হলো আমার লেখাপড়ার পর্ব । প্রথমে ছিলাম প্রধান শিক্ষকের শ্বশুর বাড়ি দ্বারাপ নগরে, প্রায় 10 কিলোমিটার পথ প্রতিদিন দুবেলা পায়ে হেঁটে ক্লাস করতে যেতাম । কিছুদিন পর সেখান থেকে প্রসাদ পুর জুম্মা মসজিদে এলাম, তারপর গোকুলপুর মসজিদে এলাম মৌঃ মারহুম আসিরুদ্দিন সাহেবের তত্বাবধানে – 1995 সাল পর্যন্ত এই মসজিদে ছিলাম, এখানেই আমার লেখাপড়ার ভিত তৈরী হয় । বালি গ্রামিন জুনিয়র হাইস্কুল ( এখন হাইস্কুল ) পঞ্চম শ্রেনীতে ভর্তি হই । খুব সকালে মাদ্রাসায় ক্লাস করে তারপর সকাল 10:30 টা থেকে স্কুল করতাম । অষ্টম শ্রেনীতে যখন উর্ত্তীন হলাম তখন বাবা হঠাৎ মারা গেলেন । সেইসময় আমি কিছুদিন হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়েছিলাম, যাইহোক সেটা ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠলাম । নবম শ্রেনীতে নিমতলা হাইস্কুলে ভর্তি হলাম । মৌঃ মারহুম আসিরুদ্দিন সাহেবের মাধ্যমে নিমতলা মসজিদে জায়গীর হই । কিন্তু অর্থের অভাবে বই কিনতে পারিনা, টিউশন পড়তে পারিনা । বন্ধু-বান্ধবদের কাছে বই, নোট পড়াশোনে করতে লাগলাম । 1997 সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উর্ত্তীন হয়ে লালবাগ নবাব বাহাদুরস বিদ্যালয়ে কলা বিভাগে আরবী নিয়ে ভর্তি হলাম । সেই সময় কিছুদিন চুনাখালি মসজিদে ছিলাম, পারিশ্রমিক হিসেবে স্বল্প কিছু পেতাম । তারপর কিছুদিন লালবাগে আমার প্রিয় বন্ধু আব্দুল লতিফ সরকারের সঙ্গে ভাড়া ছিলাম, টাকার অভাবে ভাড়া থাকা দায় । অবশেষে লালবাগ বাগিচা পাড়া মসজিদে জুম্মা ও আরবী পড়ানোর দায়িত্ব পেলাম, কিছুটা হলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম । এই ভাবে 1999 সালে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করলাম । টাকার অভাব, তবুও সাহস করে মৌলানা আজাদ কলেজে আরবী অনার্স নিয়ে ভর্তি হলাম । আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক হাবিবুর রহমানের সহযোগিতায় সরকারী বেকার হোস্টেলে রাকিবুদ্দিনের রুমে গেস্ট হিসেবে থাকতে লাগলাম । হোস্টেল জীবন আমার গেস্ট হিসেবেই কেটেছে । আর্থিক অনটনের জন্য কলকাতায় বেশিদিন থাকতে পারলাম না, হোস্টেল খরচ চালানো আমার পক্ষে খুবই কঠিন ছিল । আমার পরিচিত জায়গায় আমার জন্য জাকাত, ফিতরা, কোরবানীর টাকা রেখে দিত – অনেকেই ব্যক্তিগত দানও করেছিলেন । হস্টেলের বন্ধুদের থেকেও অনেক সাহায্য পেয়েছি, যেমন – সেখ নিয়াজুল ইসলাম, রেজাউল, সামাউন ইসলাম, কাজী গোলাম মহিউদ্দিন(অপু) ও প্রমুখ । শ্রদ্ধেয় শিক্ষক হাবিবুর রহমানের অবদান অবিস্মরনীয় । কলকাতাই থাকাকালীন এমনকি তিন্ দিন টাকার অভাবে না খেয়ে থেকেছি । কেউ সকালে ডেকে এক কাপ চা বিস্কুট খাওয়ালে মনে হতো সে আমাকে অনেক কিছু দিয়ে দিল । এই ভাবে 2002 সালে B.A(Hons) পাশ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবী নিয়ে M.A. ভর্তি হলাম । কিছুদিন পর বেকার হোস্টেল থেকে কারমাইকেল হোস্টেলে চলে আসি । কিন্তু অভাব পিছু ছাড়েনা । বন্ধুবর আব্দুল লতিফ সরকার প্রায় যেতো খোঁজ খবর নিতে । তাঁর এবং তাঁর বাড়ির প্রত্যেকটা পরিবারের অবদানের কাছে আমি চির কৃতজ্ঞ । 2004 সালে M.A. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলাম । M.A. পরীক্ষা চলাকালীন রোখারা H.J.A. বিদ্যাপীঠ – মোরগ্রাম – এ Deputation Vacancy – তে Interview দিতে আসি । আল্লাহ পাকের রহমতে সেখানে আমি নির্বাচিত হই । এই দারিদ্রের মধ্যে লেখাপড়া চলাকালীন আমার ভেতর একটা সুপ্ত ইচ্ছা জাগে – আল্লাহ পাক যদি আমাকে প্রতিষ্ঠিত করে, তাহলে আমার মত অনেক দঃস্থ অসহায় গরীব ছেলেমেয়ে আছে যাদের টাকা বা বই এর অভাবে লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়, তাদের জীবনের উজ্জ্বল ভবিষ্যতে অন্ধকার ছায়া নামে না আসে – তাদেরকে যতটা পারব সাহায্য করব, যাতে টাকা পয়সা বা বই-এর অভাবে লেখাপড়া বন্ধ না হয়ে যায় । তারপর আমি M.A. পরীক্ষা শেষ করে তার পরের দিন বখরা স্কুলে join করি । 2004 সালে S.S.C. পরীক্ষা দিই । আল্লাহর রহমতে ভাল পরীক্ষা হয় । ফলপ্রকাশের পরেই জানতে পারি আমি নর্থ জোনে চতুর্থ এবং জেলায় প্রথম র্যাং করেছি । কাউন্সেলিং-এ বারুইপাড়া হাইস্কুলে আমার পোস্টিং হল, 2005 সালে 8th april শুক্রবার join করলাম । তারপর আমার পূর্বের সুপ্ত ইচ্ছা অনুযায়ী প্রত্যন্ত গ্রামের দুঃস্থ মেধা ছেলে মেয়েদের পাশে কিভাবে দাড়ানো যাই তার একটি পরিকল্পনা করতে থাকি । তাই একদিন হাফেজ আক্তারুল ইসলাম, পারভেজ সাজ্জাদ, আব্দুল লতিফ সরকার ও মাফিকুল ইসলাম সহ প্রমুখ বন্ধুদের নিয়ে কলাডাঙ্গা হাসান-হোসেন হাফিজিয়া মাদ্রাসায় একটি আলোচনা সভায় বসলাম । আলোচনায় আমি প্রস্তাব দিলাম পবিত্র ক্বুরানের প্রথম অবতীর্ণ বানী ছিল নবী করিম(স্বঃ) উপর “ইক্বরা” বা পড়ো – আল্-ক্বুরানের এই ক্রিয়াপদটিকে লক্ষ্য রেখে বিশেষ পদ(noun) আল্-ক্বিরাত করে পূর্ণাঙ্গ নামকরন করা হল – কলাডাঙ্গা আল্-ক্বিরাত চ্যারিটেবল সোসাইটি । যার মাধ্যমে অসহায় ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া সংক্রান্ত সাহায্য করা । ইসলামি দর্শনের মূল ভিত্তি হল – জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে অজানাকে জানা, শিক্ষাই একমাত্র দারিদ্র মোচন করতে পারে । শিক্ষাই মানুষকে মনুষ্যত্ব দান করে, শিক্ষাই সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অনগ্রসর সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যায় । শিক্ষাই কুসংস্কার ও অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজকে আলোকিত করতে পারে । শুধু শিক্ষাই নয় এই সোসাইটি স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি, সমাজসেবা মূলক বিভিন্ন কর্ম কান্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকবে ।
তাই 2011 সালের 20th ডিসেম্বর পূর্ণাঙ্গ নামের মাধ্যমে সোসাইটির পথ চলা শুরু হয় । আপনারা সকলে দোয়া করুন “ফিসাবিলিল্লাহ” – আল্লাহুর ওয়াস্তে এ কাজ আজীবনভর করে যেতে পারি – ইনশাল্লাহ । আপনাদের সকলের দোয়া, সাহায্য ও সহযোগিতা একান্ত কাম্য ।
সম্পাদক
আবুল কাশেম সেখ
সহকারী শিক্ষক – বারুইপাড়া হাইস্কুল (উচ্চ মাধ্যমিক)